ফুসফুস গহ্বরের ভিতরে অ্যালভিওলাই-এর বাতাস এবং এগুলোর প্রাচীরে অবস্থিত কৈশিকনালির রক্তের মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময় ঘটে।
ক. অক্সিজেন পরিবহন (Transport of Oxygen)
প্রশ্বাসের মাধ্যমে আগত বাতাস ফুসফুসে পৌছালে ফুসফুসের অ্যালভিওলাইয়ে O2-এর চাপ থাকে ১০৭ mmHg। অন্যদিকে, ফুসফুসের কৈশিকজালিকায় দেহ থেকে আগত রক্তে O2– চাপ থাকে ৪০ mmHg। সুতরাং ফুসফুস থেকে O2 ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ফুসফুসীয় ঝিল্লি ভেদ করে রক্তে প্রবেশ করে। এই ব্যাপন যতক্ষণ না রক্তে O2-এর চাপ ১০০ mmHg উপনীত হয় ততক্ষণ অব্যাহত থাকে। রক্তে অক্সিজেন দুইভাবে পরিবাহিত হয়: ভৌত দ্রবণরূপে ও রাসায়নিক যৌগরূপে।
i. ভৌত দ্রবণরূপে : প্রতি ১০০মি.লি. রক্তে ০.২ মি.লি. অক্সিজেন ভৌত দ্রবণরুপে পরিবাহিত হয়। দ্রবীভূত অংশই রক্তে ১০০ mmHg চাপ সৃষ্টির জন্য দায়ী। তবে অংশের পরিমাণ খুব সামান্য বলে তা টিস্যুকোষে অক্সিজেন সরবরাহ কাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করে না। তবে অক্সিজেন ও হিমোগ্লোবিনের সংযোজন কাজে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
ii.রাসায়নিক যৌগরূপে : O2রক্তে প্রবেশের পর লোহিত কণিকায় অবস্থিত হিমোগ্লাবিন-এর সাথে যুক্ত হয়ে অক্সি-হিমোগ্লোবিন গঠন করে। এটি একধরনের শিথিল রাসায়নিক যৌগ, যা অক্সিজেনের চাপ কমে গেলে পুনরায় বিযুক্ত হয়। এ সংযোজন রক্তে অক্সিজেনের দ্রবীভূত অংশের চাপের উপর নির্ভরশীল। এ চাপ যত বাড়ে হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সাথে তত বেশি সংযুক্ত হয়।
Hb4+4O2⇋4HbO2 [Hb= হিমোগ্লোবিন ]
খ. কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবহন (Transport of Carbon dioxide):
শর্করা জারণের সময় কোষে CO2 সৃষ্টি হয়। এই CO2 দেহের জন্য ক্ষতিকর। কোষ থেকে CO2 রক্তে পরিবাহিত হয়ে ফুসফুসে পৌঁছায় এবং ফুসফুস থেকে বায়ুতে মুক্ত হয়। নিচে বর্ণিত তিনটি ভিন্ন পদ্ধতিতে CO2 রক্তে পরিবাহিত হয়।
i. ভৌত দ্রবণরূপে : কিছু পরিমাণ (৫%) CO2 রক্তরসের পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড গঠন করে।
H2O + CO2 → H2CO3 (কার্বনিক এসিড)
এ বিক্রিয়ায় কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ এনজাইম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
প্রতি হাজার CO2 অণুর মধ্যে মাত্র এক অণু H2CO3 রূপে দ্রবণে উপস্থিত থাকে। সুতরাং, CO2-এর খুব সামান্য অংশই H2CO3 রূপে পরিবাহিত হয়।
ii. কার্বামিনো যৌগরুপে :
টিস্যুকোষ থেকে রক্তের প্লাজমায় আগত CO2 -এর কিছু অংশ লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে। লোহিত কণিকার মধ্যে যে হিমোগ্লোবিন থাকে তার গ্লোবিন (প্রোটিন) অংশের অ্যামিনো গ্রুপের-(NH2) সাথে CO2 যুক্ত হয়ে কার্বামিনোহিমোগ্লোবিন যৌগ গঠন করে।CO2-এর একাংশ প্লাজমা প্রোটিনের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে কার্বামিনোপ্রোটিন গঠন করে।
মোট CO 2-এর শতকরা ২৭ ভাগ কার্বামিনো যৌগরূপে পরিবাহিত হয়। প্রতি ১০০ মি.লি. রক্তে এর পরিমাণ ৩ মি.লি. যার ২ মি.লি কাৰ্বামিনোহিমোগ্লোবিনরূপে এবং ১ মি.লি কার্বামিনোপ্রোটিনরূপে পরিবাহিত হয়।
iii. বাইকার্বোনেট যৌগরূপে :
CO2-এর বেশির ভাগই (৬৫%) রক্তে বাইকার্বোনেটরূপে পরিবাহিত হয়। এটি- (১) NaHCO3– রূপে প্লাজমার মাধ্যমে এবং (২) KHCO3 -রূপে লোহিত কণিকার মাধ্যমে পরিবাহিত হয়।
টিস্যুরস থেকে CO2 প্রথমে প্লাজমায় ও পরে লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে। কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে লোহিত কণিকার মধ্যে CO2 পানির সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড (H2CO3) উৎপন্ন করে। রক্তরসে কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ অনুপস্থিত থাকায় রক্তরসে খুব কম মাত্রায় কার্বনিক এসিড উৎপন্ন হয়।
লোহিত কণিকায় উৎপন্ন H2CO3 বিশ্লিষ্ট হয়ে H+ ও HCO3– আয়নে পরিণত হয়। লোহিত কণিকায় বেশি মাত্রায় HCO3– সঞ্চিত হওয়ায় এর ঘনত্ব প্লাজমার তুলনায় বেশি হয়।
আয়ন লোহিত কণিকা থেকে প্লাজমায় পরিব্যাপ্ত (diffuse) হয় এবং পাজমার Na+ আয়নের সাথে মিলে NaHCO3 উৎপন্ন করে। লাহিত কণিকার মধ্যে K+ আয়নের সাথে HCO3– বিক্রিয়া করে KHCO3 এ পরিণত হয়।
লোহিত কণিকা থেকে প্লাজমায় HCO3– আয়ন আগমনের সাথে সমতা রেখে প্লাজমা থেকে CI– লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে এবং লোহিত কণিকায় K+ আয়নের সাথে যুক্ত হয়ে KCI গঠন করে। লোহিত কণিকা থেকে HCO3 আয়ন বেরিয়ে আসায় ঋণাত্মক আয়নের যে ঘাটতি হয় প্লাজমার ক্লোরাইড (CI–) আয়ন লোহিত কণিকায় প্রবেশ করে সে ঘাটতি পূরণ করে। একে ক্লোরাইড শিফট (chloride shift) বলে। এর প্রথম বর্ণনাকারী জার্মান শারীরবৃত্ত্ববিদ হার্টগ জ্যাকব হ্যামবার্গার (Hartog Jacob Hamburger)-এর নাম অনুসারে ক্লোরাইড শিফটকে হ্যামবার্গার শিফটও বলা হয়।